স্মৃতির পাতায় এক সময়ের জাতীয় দল ও মোহামেডন-আবাহনীর তারকা ফুটবলার স্টপার ব্যাক রনজিত
…সেই আশি-নব্বুই দশকের ঢাকা মাঠের হিরো জাতীয় দল,কুমিল্লা জেলা তথা মোহামেডান ও আবাহনীর সুদর্শন তারকা ফুটবলার রক্ষনদূর্গের কৃতি খেলোয়াড় রনজিত সাহা…ঠান্ডা মাথার কুশলী ফুটবলার রনজিত ছিলেন দলের আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক…খেলেছেন দীর্ঘদিন দাপটের সাথেই…খেলাটাকে বিদায় জানিয়ে নব্বুই দশকের শেষ দিকে যেয়ে প্রায় দুদশকেরও বেশী সময় ধরে ভাল লাগার প্রিয় ফুটবলার রনজিত স্থায়ী ভাবে বসবাস করছেন আমেরিকায়…খেলাটা ছেড়েছেন সেই কবে…গেলোকাল দেখা হলো রনজিতের সাথে প্রায় ২৫ বছর পর…তবে এতটা বছর পর একটুও যেন বদলাননি রনজিত…রয়েছেন আগের মতই…সেই হাসিমুখ-রসিকতায় ভরা কথার মালা রয়েই গেছে…শুধু হারিয়েছেনে মাথা ভরা ঝাকরা চুল…মজার ব্যাপার বেশ কিছু দিন আগে একবার সেদিন-আজ দুসময়ের দুটো ছবি এক করে ফেইসবুকে পোষ্ট করেছিলাম…যা দেখে রনজিতের বর্তমান সময়ের এক ফেইসবুক বন্ধু জানতে চেয়ে লিখেছিলেন দাদা চুল গুলো কি আসল নাকি নকল…সঙ্গত কারনেই মত প্রকাশটা…কারনটা আর কিছুই নয় আজকের টাক মাথার রনজিতকে মেলানোই যায়না সেদিনের ঝাকড়া চুলের সুদর্শন ফুটবলার সেই রনজিতের সাথে…
…দেশ ছেড়ে যাবার আগে নিয়ে গেলেন আমার সংগ্রহে জমিয়ে রাখা তার পুরো খেলোয়াড়ী জীবনের সুখগাথা স্মৃতির নানা দুর্লভ ছবি সম্বলিত এক ব্যানার…এবং সেই সাথে ‘মহাপাগল ব্যতিক্রমধর্মী মোহামেডান সমর্থক দলের’ পক্ষে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা টি.ইসলাম তারেকের দেয়া সম্মাননা স্মরক…মোহামেডানের ভক্তদের প্রিয় তারকা রনজিত যেমন দলকে নেতৃত্বে দিয়ে ট্রফি এনেদিয়েছেন তেমনি দলটার বেশ কিছু সাফল্যের পেছনে অবদানও রেখেছিলেন…তাইত রনজিতকে ভোলেননি সাদা কালোর সমর্থকদের অনেকেই…আজও যেন রনজিতকে শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় স্মরন করেন তার ভক্তরা…তাইত বহু বছর পর প্রিয় তারকা রনজিতকে কাছে পেয়ে মহাপাগল ব্যতিক্রমধর্মী মোহামেডান সমর্থক দলের পক্ষ থেকে টি.ইসলাম তারেক সম্মননা স্মারকটি তুলে দেন রনজিতের হাতে…দুর্লভ ছবির ব্যানার আর সম্মননা স্মারকটি হাতে পেয়ে ভিষন স্মৃতিকাতর ও আবেগ আপ্লুত হয়ে ওঠেন রনজিত…বিদায়ক্ষনে ‘মহাপাগল ব্যতিক্রমধর্মী মোহামেডান সমর্থক দলের’ উদ্যেশে রনজিত বলে যান আপনারা যেভাবে আজও সাদা কালোর ঐতিহ্যবাহী দলটার অতীত তরকাদের যেভাবে ভালবাসার টানে সম্মান দেখিয়ে চলেছেন নানা ভাবে তার তুলনা নেই…ভাবতেই অবাক লাগে মোহামেডানের আজকের চরম হতাশার চিত্র দেখেও মহাপাগল দলটা মাঠে গিয়ে খেলা দেখা ছাড়াও সময় করে হারানো দিনের তারকাদের সম্মানিত করে চলেছেন…মহাপাগল মোহামেডান সমর্থক দলের এ সম্মাননা স্মরক অতীতের খেলোয়াড়দের কাছে এক বড় পাওয়া সন্দেহ নেই…
…কুমিল্লার ফুটবলের গর্বের এক নাম স্টপার ব্যাক রনজিত ফুটবলটাকে ভালবেসে ছিলেন নিজ জেলার এক সময়ের জাতীয় দল ও মোহামেডানের তারকা ফুটবলার ভানু-নীহার-বাদল রায়ের খেলায় মুগ্ধ হয়েই…ঢাকা মাঠে রনজিত প্রথম খেলেছিলেন ‘৮১ সালে ধানমন্ডি ক্লাবের হয়ে…বলা চলে অল্প সময়েই রনজিত তাক লাগানো নৈপূন্য উপহার দিয়ে মন কাড়েন অনেকের…ঢাকা মাঠে একবছর কাটতেই রনজিত ঠাই করে নেন ’৮২ সালে ঢাকার প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপ আসরে বাংলাদেশ সবুজ দলে…আর ’৮৩ সালেই বলা যায় স্বপ্ন পূরনের মাঝে সুযোগ মেলে যায় বড় দল ঐতিহ্যবাহী মোহামেডানের সাদা কালো জার্সী গায়ে জড়িয়ে খেলার…রনজিতের উত্থানের মূল গল্পটা সেই শুরু…মোহামেডানে এক বছর খেলেই রনজিত ‘৮৪তে বাংলাদেশ জাতীয় যুব দলে এবং ঠিক তার পরের বছর ‘৮৫সালে সুযোগ লাভ করেন সাফ গেমসের মূল বাংলাদেশ দলে…এরপর ঢাকার প্রেসিডেন্টকাপ-সাফ গেমস-এশিয়ান গেমস-পাকিস্তানের কায়দেআযম ট্রফি সহ বেশ কটি বড় আসরে…মোহামেডানের হয়েও খেলেছেন ভারত ও নেপালের মাঠে…পরবর্তী সময়ে আবাহনীর হয়েও ভারতে একাধিক আসরে খেলেছেন…
..রনজিত ‘৮৭ সালে মোহামেডানের অধিনায়কত্ব করেছিলেন…সেবার দল লীগ ও ফেডারেশন কাপের ট্রফি দুটি ঘরে তুলে নিয়েছিলো…এছাড়াও ফুটবলার রনজিত কুমিল্লা জেলার হয়ে জাতীয় ফুটবল আসরে ও কুমিল্লা লীগে মোহামেডান-খুলনা লীগে দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরী-টাঙ্গাইল ডিসি গোল্ড কাপে সীকাষ্টম এবং আবাহনীর হয়ে খেলে ভারতের নাগজী টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি জয়ের স্বাদ নিয়েছেন…এর পাশাপাশি ঢাকা লীগ লড়াইয়ে রনজিতের দল মোহামেডান ও আবাহনী মোট ২বার করে শিরোপা জয় করে ট্রফি তুলে নিয়েছিলো ক্লাব ঘরে…
…খ্যাতিমান ব্যাক রনজিত ‘৮৩ সাল হতে ‘৮৭ সাল অবধি মোহামেডানে খেলার পরেই ‘৮৮ সালে যোগ দিয়েছিলেন আবাহনীতে…একটানা এগার বছর লীগ লড়াইয়ে অংশ নিয়েই ‘৯১ সালের পর পরই খেলার মাঠ ছেড়ে দেবার সিধান্তটা নিয়ে নেন…তার কিছু পরেই পাড়ি জমিয়েছিলেন আমেরিকায়…সেখানেই স্ত্রী ও এক কন্যা সন্তান নিয়ে তার আজ স্থায়ী নিবাস…দেশে মাঝে মাঝে ঘুরে গেলেও সেই প্রিয় চেনা ঢাকা স্টেডিয়াম আজ তাকে টানে না…আমেনিকায় বসে ফেইসবুকের কল্যানেই যতটুকুন খবরা খবর নেন…বর্তমান ফুটবলের বেহাল দশা তাকে বড্ড পীড়া দেয়…রনজিত বলেন একটা সময় সাদা কালো আর আকাশী জার্সী গায়ে জড়িয়ে খেলতে হয়েছে টানটান উত্তেজনার মধ্যে মাঠ ভরা দর্শকের সমাগমের মাঝে…আর আজ সেই চীর শক্রুর দুদল মোহামেডান ও আবাহনীর মর্যাদার লড়াইটা হয় কিনা দর্শকশূন্য গ্যালারীতে…এটাত সে সময় স্বপ্নেও ভাবা যেত না…একটা সময় ছিলো মোহামেডানের হারার স্বাদ নেয়াত পরের কথা ছোট দলের কাছে ড্র করে পয়েন্ট হারালেই রীতিমত দলীয় ভক্তরা হাঙ্গামা বাধিয়ে দিত ক্লাব প্রাঙ্গনে…ক্লাব চত্তরে ভাংচুর এমনকি আগুন ধরিয়ে দেবার ঘটনাও ঘটেছে…ওসময় মোহামেডান-আবাহনী খেলার মানেই ছিলো যুদ্ধ ঘোষনার মত…আর আজকের দিনে কবে কখন হয়ে যায় মোহামেডান-আবাহনীর লড়াই তা তেমন কেউ খোজও রাখেনা…ফুটবল লড়াইয়ে দর্শক খড়ার দিকটার সাথে সাদামাটা দল গড়ে টানা চার পাচ ম্যাচ হেরে মোহামেডানের মাঠ ছাড়ার পাশাপাশি রেলিগেশনের লড়াইয়ে নামার ব্যাপারটা তাই আমার কাছে বড় কষ্টের…
. …জাতীয় দলের সাবেক তারকা ফুটবলার রনজিত ফুটবল খেলে দর্শক ভালবাসা-জনপ্রিয়তা-সম্মান-যশ্ব-খ্যাতি প্রতিষ্ঠা সবই পেয়েছেন…তাইত অপূর্নতা নেই তার…তবে একটা দুঃখ-যন্ত্রনা আজও তাকে বেশ তাড়িয়ে বেড়ায়…আর তা হলো ফুটবলটা খেলে তার এতকিছু পাওয়ার কিছুই যে বাবাকে দেখাতে পারেননি…দুঃখটা ওখানেই খুব অল্প বয়সেই ছেলেবেলায় বাবাকে হারিয়েছেন…অথচ বাবা বেঁচে থেকে দেখে যেতে পারলে কতনা খুশি হতেন আর গর্ব করতে পারতেন…
…জাতীয় দল ও মোহামেডান-আবাহনীর সাবেক তারকা ফুটবলার কৃতি স্টপার ব্যাক রনজিতকে চেনা হয়েছিলো সেই তার ঢাকা মাঠে খেলার শুরুরক্ষন থেকেই…একটা সময় তাকে নিয়ে ক্রীড়াজগত ও বর্তমান দিনকালে বেশ লেখালিখিও করা হয়েছিলো আমার…ক্রীড়া সাংবাদিকতার পাশাপাশি ফটোগ্রাফীতে জড়িত ছিলাম বলে বেশ সুসম্পর্কও ছিলো তখন থেকেই…খেলোয়াড়ী জীবনে ’৮৭ সালে মোহামেডানের দলনায়ক থাকা সময়ে একটা কালো দাগ রয়ে যায় রনজিতের…যে দুঃখজনক ঘটনাটির স্মৃতিটা আজও তাকে ভাবায়…না ওটা কোন সংঘর্ষে জড়ানোর কান্ড ছিলোনা…অনেকটা যেন বেখেয়ালী বশেই অনাকাঙ্খিত ঘটনার জন্ম দেয়া হয়েছিলো…মর্যাদার উত্তেজনার লড়াইয়ে মুখোমুখি হয়েছিলো চীর প্রতিদন্দ্বি মোহামেডান ও আবাহনী…ফলাফল আসেনি সে খেলায়…খেলা শেষে দুদলের পয়েন্ট সমান হয়ে যায়…ওসময়টায় দলনায়ক রনজিত ও আসলাম উত্তেজিত দলীয় সমর্থকদের হাসিমুখ উপহার দেবার উপলক্ষ করে দিয়েছিলেন…স্বতীর্থ সকল খেলোয়াড়দের সাথে পরামর্শ করে একযোগে যুগ্ম চ্যাম্পিয়নের দাবী রেখে হাত তুলে মাঠের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ছুটাছুটি করে আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠেন…অতঃপর বাফুফের তরফ থেকে নেমে এলো দুজনার জন্য সে এক করুন পরিনিতি…খেলার ফলাফল তো বানচাল হলোই সাথে দুদলনায়ক রনজিত ও আসলাম হলেন সাসপেন্ড…শুধু তাই নয় দুজনকেই জাতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগটাও হারাতে হয়েছিলো…সেদিনের বাফুফের কড়া সাজার ঘোষনাটা এলে পুরো স্টেডিয়াম পাড়া গড়ম হয়ে ওঠে…প্রশাসনে স্মরকলিপি প্রদান ছাড়াও সমাবেশ-মিছিল-করে রাজপথে নেমে ফুটবলাররা ও সমর্থকরা নানা কর্মসূচিও পালন করে সাজা বাতিলের জোড় দাবীতে…তবে কঠোর থেকে সিদ্ধান্ত বাতিলের পথে আর পিছু হঠেননি বাফুফে কর্তারা…যে স্মৃতিটা আজও ভুলতে পারেননা রনজিত…মনে পড়লেই ফেলেন বেদনার দীর্ঘশ্বাস…
Recent Comments