মনে পড়ে দেশের মাটিতে প্রথম জয়ের নায়ক তারকা ফুটবলার সুদর্শন স্ট্রাইকার হাসানের কথা
… “হাসান আহমেদুল হক” ঢাকা মাঠ তথা জাতীয় ফুটবল দলের এক সময়ের খ্যাতিমান ফুটবলার…দীর্ঘকায় সুদর্শন ও স্টাইলিশ তারকা স্ট্রাইকার হাসান গোল করে যেমন মাঠ মাতিয়েছেন তেমনি যখন যে দলে খেলেছেন সে দলকে বড় সাফল্য এনে দিতে ভূমিকাও রেখেছেন…একটা সময় ছিলো দেশ সেরা দুই বড় দল মোহামেডান ও আবাহনীর বাইরে থেকে জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া আর খেলাটা ছিলো কঠিন কাজ…তবে কুশলী স্ট্রাইকার হাসান নিজ দক্ষতায় সে যোগ্যতাটা করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন…ফুটবলে হাসানের স্বল্প সময়ে মূল বাংলাদেশ দল-জাতীয় যুব দল এবং লীগ লড়াইয়ে ফায়ার সার্ভিস-দিলখুশা-মোহামেডান-রহমতগঞ্জ ও জাতীয় ফুটবল আসরে ঢাকা জেলা দলের হয়ে খেলে যত সাফল্য লাভ তার সবটুকনই সম্ভব হয়েছে বল্লেন তার ফুটবল শিক্ষা গুরু কোচ মরহুম বজলুর রহমানের অবদানেই…
…দক্ষ স্কোরার স্ট্রাইকার হাসান আজও শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় স্মরন করেন তার ফুটবল গুরু খ্যাতিমান কোচ মরহুম বজলুর রহমানকে…বলেন কোচ বজলুর রহমানই আমাকে ফুটবলার বানিয়েছে…নবকুমার ইন্সষ্টিটিউশন মাঠে এক টুর্নামেন্টে আমার খেলায় মুগ্ধ হয়েই কোচ বজলু আলাদা ভাবে টেনে তুলে নিজ হাতে গড়েছেন আমাকে…বলব তার স্নেহের পরশ না পেলে হয়ত আমি ফুটবলার হয়ে উঠতামনা…সেই প্রিয় কোচের ছবি আজও কিনা হাসানের মানিব্যাগে শোভা পায় দেখেই অবাক হতে হয়…বোঝাই যায় কতটা শ্রদ্ধাবোধ তার কোচের প্রতি…এ এক অতুলোনীয় দৃষ্টান্তই বটে…কোচ বজলুর উপদেশের একচুল বাইরেও যাননি কখনও হাসান…মাঠে যেমন কোন সময় হাসান বাজে আচরন করেননি কার্ড পাবার মতন তেমনি কোচের কথায় জীবনে কখনও কোথায়ও ভাড়া খেলতেও যাননি…যতদিন লীগ খেলেছেন কখনও টাকার ব্যাপারটা নিয়ে কথাও বলেননি…তার ফুটবল গুরু কোচ বজলুই যা বলতেন-করতেন তাই মাথা পেতে নিতেন…হাসান টাকার জন্য নয় ফুটবলটাকে গভীর ভাবে ভালবাসতেন বলেই খেলতেন…বলা যায় একজন আদর্শিক ক্রীড়াবিদ হলেন ঢাকার ফুটবলের একসময়ের পরিচিত মুখ স্ট্রাইকার হাসান আহমেদুল হক…
…হাসানের ফুটবলে হাতে খড়ি নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায়…সে সময় নবকুমার মাঠে কামাল স্পোটিংয়ের বিরুদ্ধে খেলে কোচ বজলুর নজরে পড়েছিলেন… ৫-২ গোলে ম্যাচ জেতা সেই খেলায় ২টি দৃষ্টিনন্দন গোল করেছিলেন হাসান…প্রতিভা চিনতে যেন ভুল করেননি কোচ বজলু…কাছে টেনে নিয়ে ঘষে মেজে আপন মনে নিজ হাতে গড়তে থাকেন হাসানকে…এমনকি ’৭৩ সালে দিলখুশার হয়ে প্রথম বিভাগ লীগ খেলার সুযোগটাও করে দিয়েছিলেন…দুবছর খেলার পর ’৭৫ সালে যোগ দিয়েছিলেন হাসান দিলখুশায়…সেবছর হাসানের খেলা নজড় কেড়েছিলো অনেকেরই…সে সুবাদে ‘৭৬ সালে ঐতিহ্যবাহী দল মোহামেডান তাকে দলে ভিড়িয়েছিলো…সেবছর মোহামেডানের সাদা কালো জার্সীতে খেলে নিয়েছিলেন চ্যাম্পিয়নের স্বাদ…পরের বছর আবারও দলবদল করে যোগ দেন নিজ এলাকার দল রহমতগঞ্জ ক্লাবে…সে বছর দুর্দান্ত খেলা উপহার দিয়ে হাসান তার দল রহমতগঞ্জকে প্রথমবারের মত লীগ রানার্সআপ হতে অনেকখানি ভূমিকা রেখেছিলেন…লীগ ফাইনালে শক্তিধর আবাহনীর বিরুদ্ধে খেলার শুরুতেই হাসান গোল করে তার দল রহমতঞ্জকে ১-০ গোলে এগিয়েও রেখেছিলেন…শেষমেষ অবশ্য রহমতগঞ্জকে ৩-১ গোলে হারিয়ে লীগ শিরোপা ঘরে তুলে নিয়েছিলো আবাহনী দল…
…’৭৭ সালের পর গিয়ে ‘৭৮ সালটা ছিলো স্ট্রাইকার হাসানের জন্য সফল এক মরসুম…সেবছর যোগ দিয়েছিলেন ’৭৩-র লীগ চ্যাম্পিয়ন অফিস দল বিজেএমসি ক্লাবে…সেবছর লীগে এক হ্যাটট্রিক সহকারে করেছিলেন দ্বিতীয় সর্বাধিক ১০ গোল…যা মন কেড়েছিলো অনেকেরই…সে বছরই প্রথমবারের মত জাতীয় যুব ফুটবল দলে খেলার সুযোগটা লাভ করে নিজেকে তুলে ধরেন দারুনভাবে…পরের বছর দেশের সেরা দুই বড় দল মোহামেডান ও আবাহনীকে পেছনে ফেলে বিজেএমসির লীগ চ্যাম্পিয়নের পেছনে হাসানের অবদান ছিলো অনেকখানি…বেশ কিছু মনকাড়া গোল করেছিলেন হাসান…লীগের শেষপ্রান্তে যে খেলায় ওয়ারীকে ৪-১ গোলে হারিয়ে বিজেএমসি তাদের লীগ চ্যাম্পিয়ন নিশ্চিত করেছিলো সে খেলাতেও হাসানের ছিলো চমকপ্রদ হ্যাটট্রিক…ফর্মের তুঙ্গে থেকে ‘৮০র মরসুমটা শুরু করেছিলেন হাসান তবে এক পর্যায়ে ইষ্টএন্ডের বিরুদ্ধে খেলায় গোলকিপার বাদলের মারাত্মক আঘাতে যেন শেষের গল্পটা লেখা হয়ে যায় হাসানের…পরের বছর পুরানো দল রহমতগঞ্জে যোগদিলেও মাঠে আর ফেরা হয়নি পুরানো ছন্দে…অবশেষে ‘৮২তেই বুট জোড়া তুলে রেখে মাঠ থেকে বিদায় নিয়ে নেন হাসান…
…হাসানের মূল উত্থানটা ছিলো ‘৭৮ সালেই…সেবছরই প্রথম জাতীয় দলের জার্সী গায়ে জড়িয়েছিলেন কৃতি স্ট্রাইকার হাসান…দারুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত রেখেই যেন জাতীয় যুব দলের হয়ে খেলার সূচনাটা করেছিলেন…সেবছরই দেশের মাটিতে ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রথম ২১টি দেশকে নিয়ে এশিয়ান যুব ফুটবলের মত জমজমাট আন্তর্জাতিক আসরটি বসেছিলো…আসরকে সামনে রেখে সেবার নতুন করে সেজেছিলো ঢাকা স্টেডিয়াম…প্রথম ম্যাচে ভাল খেলেও ২-২ গোলে ড্র করেছিলো বাংলাদেশ দল প্রতিপক্ষ সিঙ্গাপুরের সাথে…দ্বিতীয় খেলায় যেয়ে বাংলাদেশ দল দেশের মাটিতে আন্তর্জাতিক ফুটবলে প্রথম ঐতিহাসিক স্মরনীয় জয়টি তুলে নিয়েছিলো ইয়েমেনের বিরুদ্ধে…সেদিন ম্যাচ জয়ের নায়ক ছিলেন কুশলী গোলদাতা স্ট্রাইকার হাসান…দ্বিতীয়ার্ধের ২৮ মিনিটে মাঝ মাঠের নিপূন কারিগর বাবলু একক প্রচেষ্টায় বল নিয়ে বিপদ সীমানায় ঢুকে পড়ে গোল লাইন থেকে যে নিপুন ব্যাক পাস করেছিলেন তা থেকে হাসান মন মাতানো প্লেসিং শটে বলকে জালে জড়িয়ে দিয়ে অর্ধলক্ষাধিক দর্শককে আনন্দ উল্লাসে ভাসিয়ে দেন…শেষমেষ স্ট্রাইকার হাসানের দেয়া একমাত্র গোলেই জয়ের স্বাদ নিয়ে মাঠ ছাড়ে বাংলাদেশ যুব দল…আর রচিত হয় যেন বাংলাদেশ ফুটবলের নতুন এক ইতিহাস…দেশের মাঠে প্রথম আন্তর্জাতিক আসরে জয় বলে কথা…স্ট্রাইকার হাসান তাই হয়ে ওঠেন ইতিহাসের বড় নায়ক…সেদিনের মাঠ ভরা দর্শকের স্মৃতিতে আজও জল জ্বলে হয়ে আছে হাসানের সেই সুখগাথা জয়সূচক গোলটি তা না বল্লেই নয়…মনে পড়ে তাই প্রথম জয়ের নায়ক গোলদাতা হাসানকে…সেই মনকাড়া গোল হাসানকে আজও স্মরনীয় করে রেখেছে এবং রাখবে অনন্তকাল…প্রথম জয়ের স্মৃতি কিনা তাই…
…দারুন সম্ভাবনা জাগানো স্ট্রাইকার হাসান এশিয়ান যুব ফুটবলের পর একই বছর আবাহনীর ৭ ফুটবলার জাতীয় দলে অধিনায়ক বদলের ন্যাক্কারজনক কান্ডের প্রতিবাদে ব্যাংকক এশিয়ান গেমসে অংশ না নিলে নাটকীয় ভাবে দলের সাথে যোগ দিয়েছিলেন…পরের বছর ’৭৯তে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান কাপ ফুটবলেও হাসান বাংলাদেশ দলে খেলার সুযোগ লাভ করেছিলেন…ওদিকে সেবছর লীগ ফুটবলে বিজেএমসিকে চ্যাম্পিয়নের পেছনে অবদান রেখে যখন ফর্মের তুঙ্গে থাকলেন তখনই দুভার্গ্য নেমে আসে তার ফুটবল জীবনে… ‘৮০র মরসুমে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ছিটকে পড়েন…আর ভালভাবে ফেরা হয়ে ওঠেনি তার…আঘাতটা না পেলে নির্ধিদায় বলা যায় আরো অনেকদুর যাওয়া হত হাসানের…পেতেন বড় তারকার খ্যাতি-যশ্ব-সুনাম-জনপ্রিয়তা সবই…ভাগ্যের নির্মমতা যেন দেয়নি তাকে সে সুযোগ…তবে একথা বলা যায় দেশের মাটিতে প্রথম জয়ের সেই স্মরনীয় গোলের সুখকর মধুর স্মৃতিটা হাসানকে জাগ্রত রাখবে অনেক অনেক দিন…লেখা থাকবে তার নাম ইতিহাসের পাঁতায়…
…জাতীয় দল ও ঢাকা লীগ খেলার বাইরে হাসান শেরেবাংলা কাপ জাতীয় ফুটবল খেলেছিলেন কবছর ঢাকা জেলার হয়ে…১৯৮০ সালে নেতৃত্বও দিয়েছিলেন ঢাকা জেলা দলের…সেবছর তার নেতৃত্বে ঢাকা জেলা জাতীয় ফুটবলে রানার্সআপও হয়েছিলো…ফুটবলের বাইরে একটা সময় এ্যাথলেটিকসে হাসানের বড্ড দুর্বলতা ছিলো…বিশেষ করে ১০০-২০০ মিটার দৌড় আর লংজাম্প ছিলো তার প্রিয় ইভেন্ট…স্কুল প্রতিযোগিতায় অনেক পদকও জয় করেছিলেন… ১৯৭৪ সালে ঢাকা পগোজ স্কুলের ছাত্র অবস্থায় হাসান একবার ঢাকা সিটি এ্যমেচার এ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার দৌড়ে প্রথম হয়ে ঢাকা শহড়ের দ্রুততম মানব হবার গৌরবও অর্জন করেছিলেন…
…’৮২তে খেলা ছেড়ে দেবার পর ফুটবলের সাথে আর নিজেকে জড়াননি হাসান….পারিবারিক ব্যবসায়ে মন দেন হাসান…ব্যক্তিজীবনে সফল এই মানুষটি দুই মেধাবী পুত্রের জনক…আদর্শিক এক পিতা…প্রিয় কোচ বজলুর রহমানেরেএকটা ছবি সযত্নে মানিব্যাগে রেখে তারই দেয়া ভাল ফুটবলারের পাশাপাশি ভাল মানুষ হবার পথ দেখানো উপদেশ গুলো আজও যেন মেনে চলেছেন অক্ষরে অক্ষরে…হেটে চলেছেনে আজও সে পথ ধরেই…নিজের সন্তানদেরও সে শিক্ষায় মানুষ করেছেন…যা নতুন প্রজন্মের ফুটবলারদের জন্য অনুকরনীয় হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে…
Recent Comments