রংপুরের সেই নাসির এখন বাংলাদেশের নাসির

nasir-0জন্ম তার রংপুরের দেওয়ানবাড়ীতে ।নিম্ন মধ্যবিত্তের সাধারন ঘরেই তার বেড়ে উঠা। ৪ ভাই ১ বোনেরমধ্যে নাসির ৪ নাম্বার । বাবা ছোটখাট একটা চাকুরী করেন,মা গৃহীনি ।জয়েন্ট ফ্যামিলীর মতই বাবা-মা ভাই বোনের সাথে চাচাদের নিয়ে থাকা।সবার সাথে বলতে হয় খুব মজা করেই কেটেছে তার ছেলে বেলা। উচ্চ বিত্তের বড় আদরের সন্তানের মত সোনার চামুচ মুখে দিয়ে তার জন্ম হয়নি ঠিক তবে বলা যায় অনেক ঘাম ঝড়িয়ে নিজের মেধা-শ্রম-সাধনা ও চেষ্টার গুনেই হয়েছেন যেন সোনার চেয়েও দামী এক ক্রিকেটার।যার খ্যাতি-সুনাম আজ ছড়িয়ে গেছে দেশ হতে দেশের বাইরেও।বলা যায় ব্যাট হাতে দুর্দান্ত ঝলকে ক্রিকেট বিশ্বে নিজের নামটি চিনিয়েছেন ভাল করেই।টাইগার ভক্ত সবাই ভালবাসার মায়া জড়িয়ে তাকে ডাকে মিষ্টার ফিনিশার বলে।ডাকবেই না কেন বেশ কিছু ম্যাচ যে অসাধারন ব্যাট করে দলকে এনে দিয়েছেন জয়ের স্বাধ।এই সেই রংপুরের নাসির আজকের বাংলাদেশের নাসির।মিষ্টার ফিনিশার।

...বাঁ হতে মিষ্টার ফিনিশার নাসিরকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন বোর্ড প্রধান পাপন-মুশফিকের বাবা-সাকিব ও রিয়াদ...

…বাঁ হতে মিষ্টার ফিনিশার নাসিরকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন বোর্ড প্রধান পাপন-মুশফিকের বাবা-সাকিব ও রিয়াদ…

নানা অভাব অনটনে থাকা পরিবারের সন্তানের যখন উচিত জীবন যুদ্ধে প্রতিষ্টিত হয়ে স্বচ্ছল ভাবে চলার তাগিদে মন দিয়ে পড়ালেখায় ডুবে থাকা তখনি নাসির যেন পড়া লেখায় কিছুটা অমনোযোগী হয়ে মেতে থাকে ক্রিকেট নামক একটা নেশায়।বলব ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি তার যত স্বপ্ন-ভালবাসা।চাচারা রোজ ক্রিকেট খেলতেন।আর তাই দেখেই নাসির ব্যাট-বল নিয়ে মগ্ন থাকার নেশায় মাতেন।ক্রিকেটের প্রতি বাবা মায়ের সাপোর্ট ছোট বেলায় কমই পেয়েছেন নাসির।কিন্তু চাচারা সাপোর্ট দিয়ে গেছেন ভিশন।তবে পড়াশুনাটা ঠিক রেখে।

ছেলে বেলায় বেশ দুষ্ট আর ডানপিটে স্বভাবের ছিলেন নাসির। স্কুল ফাকি দিয়ে অনেক সময় বড় ভাই সহ ক্রিকেট খেলা দেখতে যাওয়ার কারনে বাবা-চাচাদের হাতে পিটুনি খাওয়ার ঘটনাও আছে তার।শুধু কি তাই অতিমাত্রায় ক্রিকেট নিয়ে পড়ে থাকার কারনে বাসা হতে বের করে দেয়ার কান্ডও ঘটিয়েছেন।যদিও রাতে চাচারা ডেকে এনে বুকে জড়িয়ে নিয়েছেন।

...তিন বিভাগেই রয়েছে নাসিরের যেন দাপট...

…তিন বিভাগেই রয়েছে নাসিরের যেন দাপট…

নাসিরের ক্রিকেট জীবনের শুরুটা চাচাদের দেখে দেখে হলেও রংপুর ক্রিকেট গার্ডেনের সাকিব নামক এক ক্রিকেট প্রেমিকের হাত ধরেই যেন নুতন করে স্বপ্ন দেখার সূচনা তার।সাকিব সাহেব কেন যানি মায়ার বাধনে জড়িয়ে নিয়েছিলেন ক্রিকেট পাগলামীতে মেতে থাকা স্কুল বয় ছোট্ট নাসিরকে।আর তাইত নিজেই রোজ রোজ রিক্সা ভারা করে নাসিরকে নিয়ে যেতেন একাডেমিতে।দিন গড়ানোর সাথে সাথে একটা সময় ক্রিকেটকে নেশার পাশাপাশি জীবনের সাথে এক সূঁতোয় বেধে ফেলেন সেই ডানপিটে ছেলে নাসির।

এরমাঝে রংপুরে আয়োজন করা হয় জুনিয়র দল গঠন কল্পে কিশোর প্রতিভাদের নিয়ে বিশেষ কোচিং ক্যাম্প।শ্রীলঙ্কার কোচ চার্লি এসেছিলেন প্রশিক্ষন দিতে।অস্থির হয়ে উঠেন নাসির ক্যাম্পে যোগ দিতে।নাসিরদের বাসা থেকে রংপুর স্টেডিয়ামের দুরত্ব ছিলো প্রায় ২কিলোমিটার।সামর্থ্য ছিলোনা বলে কষ্ট করে রোজ রোজ দুরের পথ পায়ে হেটেই যেতেন নাসির।ক্যাম্পে যোগ দেবার কারনে প্রতিদিন ১ শত করে টাকা দেয়া হতো।মজার ব্যাপার সেই টাকা পুরোটাই জমিয়ে রাখতেন ভবিষ্যতের স্বপ্ন ক্রিকেটার হওয়ার পিছনে ব্যায় করতে।একটা সময় যানা হলো চূড়ান্ত ভাবে নাছিরকে বাছাই করা হয়নি।বাসায়ত সবাই অবাক।ক্যাম্পে অনেক ভালো করেও কেন বাদ পড়া তা অজানাই থেকে যায় সবার কাছে।বাদ পড়ার ঘঠনায় এতটাই ভেঙ্গে পড়েছিলেন যে ৭ দিন পর্যন্ত খাওয়া ও মুখে দেয়নি সেদিনের ক্রিকেট পাগল কিশোর নাসির।এখানে মজার ব্যাপার হলো নাসিরের ব্যাপারে ভেবে দেখার কথা উঠলে বলা হয় ছেলেটা এতো ছোট যে প্যাড পড়ে ও ঠিকভাবে চলাচল করতে পারে না।আর প্যাড বুকে চলে আসে।শেষমেষ কিশোর নাসিরের ক্রিকেটের প্রতি দুর্বার আকর্ষন-আগ্রহ সেই সাথে উজ্জল প্রতিভার সম্ভাবনা উপলব্দি করেই যেন তাকে দলে রেখে দেয়া হয়।তবে কপালটাই খারাপ নইলে কেনইবা জুনিয়র আসরটা স্থগিত হয়ে যাবে কোন এক কারনে।জীবনের প্রথম কোচিং ক্যাম্পে প্রথমাবস্থায় বাদ পড়াটাই যেন সেদিনের ক্রিকেট ক্রেজী বয় নাসিরের আরো ভাল করার আর উপরে উঠার জিদটা এনে দিয়েছিলো বেশী রকম।

...বাঁয়ে প্রিয় ভক্তদের অটোগ্রাফ দেয়ায় মগ্ন নাসির...মাঝে ম্যাচ সেরার পুরস্কার হাতে নাসির...ডানে গ্রামীন ফোনের নয়া সেন্টারের উদ্ভোদন করছেন নাসির...

…বাঁয়ে প্রিয় ভক্তদের অটোগ্রাফ দেয়ায় মগ্ন নাসির…মাঝে ম্যাচ সেরার পুরস্কার হাতে নাসির…ডানে গ্রামীন ফোনের নয়া সেন্টারের উদ্ভোদন করছেন নাসির…

অত:পর একটা সময় অনেক আশা-স্বপ্ন বুকে নিয়ে বন্ধুদের সাথে পাড়ি জমান ঢাকায়।সাথে থাকে অনেক যত্নে নিজের জমানো মাত্র ৩ হাজার টাকা।স্বপ্নের লক্ষ্যটা আর কিছুই নয় সিড়ি বেয়ে উপরে উঠার জন্য বড় একটা সুযোগ।শুরুর সে স্বপ্নটা হলো বিকেএসপিতে ভর্তি।বিকিএসপিতে প্রাথমিক ক্যাম্পেইন শেষে ছটফট করতে করতেই যেন বাড়ীতে ফেরা।ঠিক ২০ দিন পর চিঠি এলো।খামটা খুলেই সেদিনের ক্রিকেট পাগল কিশোর নাসিরের সে কি আনন্দ-উল্লাস।আর চিৎকার করে বলতে থাকলেন বাবা..মা..টিকে গেছি।টিকে গেছি। সেবার বিকেএসপির সেই ভর্তি লড়াইয়ে ১ হাজার কিশোর প্রতিভা অংশ নিলেও চূড়ান্ত ভাবে বাছাই করা হয় মাত্র ২০ জনকে।কিন্তু হায় খুশির মাঝেও যে ছিলো ক্ষনিকের যন্ত্রনা।অস্বচ্ছল এই পরিবারের ছেলেটা কিভাবে ঢাকায় থাকবে।সবারই দু:শ্চিন্তার কারন হয়ে দেখা দেয় বড় খরচ কেমন করে সামলানো হবে।সিদ্ধান্তের টানাপড়নে থাকলো বাড়ীর সবাই।একটা সময় নাসিরের ভর্তির ব্যাপারটা ফাইনাল হলো।সে কি খুশি তখন নাসিরের।

বিকেএসপিতে সপ্তম শ্রেনীতে ভর্তি হলেও নাসিরের পিছু ছাড়েনি অভাব অনটন।বাবা মায়ের স্নেহ আদর পেতে মন টানলেও বাড়তি খরচের কথা ভেবে বাড়ী যাওয়া হতনা ঘন ঘন।প্রায় দু তিন মাস পর পর রংপুরে যেতেন আপন ঠিকানায় নিজ বাড়ীতে।ওসময়টায় বিশেষ করে চাচারা হেলপ না করলে বাড়ীতেও যাওয়া হয়ে উঠতনা নাসিরের।তবে অভাব কখনই নাসিরকে হতাশায় ডুবে মারেনি।বরং প্রতিনিয়ত তাকে আরো জেদী ও সিরিয়াস করে তুলেছে।নিজেকে প্রতিষ্টিত করতে দিনের পর দিন অনেক কষ্টের মাঝেও ঘাম ঝড়িয়ে গেছেন নিরলস অনুশীলনের মাঝে সময় কাটিয়ে।এরপরের ঘটনাতো ধাপে ধাপে স্বপ্ন পূরনের আর প্রতিষ্ঠার ইতিহাস।সে ইতিহাস যেন সবারই ভাল করে যানা।

...ফ্যাশন সচেতন ষ্টাইলিশ নাসির...

…ফ্যাশন সচেতন ষ্টাইলিশ নাসির…

যে লালিত স্বপ্ন নিয়ে খেলোয়াড় তৈরীর কারিগর বিকেএসপিতে ভর্তি হয়েছিলেন নাসির তা যেন ষোল আনাই পূরন করে ছেড়েছেন অক্লান্ত পরিশ্রম এবং পরিবারের-কোচের আর অন্য সবার দোয়ায়।এক এক করে যেন নাসির সাফ্যলের সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে এসেছেন।জুনিয়র লেবেল আসরে ব্যাটিং-বোলিং ও ফিল্ডিংএ অতুলোনীয় নৈপূন্যের সাক্ষর রেখেই যেমন নজড় কাড়েন সবার তেমনি নিজ যোগ্যতার গুনেই নাসির সুযোগ করে নেন বাংলাদেশ অনুর্ধ ১৫-১৭-১৯ দলে।থেমে থাকেনি তার এগিয়ে যাবার পথ।এরপর বিসিবি ডেভোলাপমেন্ট দল হয়ে বাংলাদেশ এ দলেও সুযোগ করে নেন নাসির সেই একই সাফল্যের ধারায়।অতঃপর লীগ ও জাতীয় আসর গুলোতে দারুন ভাবে ব্যাটে-বলে জ্বলে উঠে মূল বাংলাদেশ দলে খেলার স্বপ্ন পূরন করেন নাসির।আর গর্বিত করেন কোচ সহ বাবা-মা,ভাই বোন এবং খুব আপন চাচাদের।যাদের প্রেরনা-উৎসাহ-সহযোগীতা নাসিরের জীবনে পাথেয় আছে আজও।

প্রতিষ্টিত হবার পর জাতীয় দলে ভাল  খেলে যখনই নাসির বাড়ীতে মায়ের কাছে ছুটেে গেছেন দেখেছেন মায়ের চোঁখে জ্বল।জানতে যেন চাইলে মা বলতেন এ তোর সাফল্যের সুখের আনন্দ অশ্রু।অনেক আদরে মা কখনই বুঝতে দিত না সে চোঁখের জ্বলের মাঝেও যে লুকিয়ে আছে সংসারের সেই দুঃসময়ের দিন গুলোর কথা।মা হয়তবা এইভেবে চোঁখের জ্বল ফেলতেন যে নাসির একবেলা পেট ভরে খেতে পারতো না,পরিবার থেকে একটা নতুন জামা পেত না,নিজের একটা ব্যাটও ছিল না সে আজ বাংলাদেশের নাসির।বিশ্ব ক্রিকেট দরবারের পরিচিত নাসির।

...২০০৬ এর বিশ্ব জুনিয়র বিশ্বকাপের বাংলাদেশ দলের মাঝে নাসির...ডানে সাকিব ও তামিমের মাঝে নাসির...

…২০০৬ এর বিশ্ব জুনিয়র বিশ্বকাপের বাংলাদেশ দলের মাঝে নাসির…ডানে সাকিব ও তামিমের মাঝে নাসির…

তবে আজকের নাসির সেই নাসিরকে কখনোই বড় উচ্চতায় দেখে ভুলে যায়না।কারন বার বার কানে ভাসে মায়ের উপদেশ মাখা একটা কথা “মা বলতেন বাবা কখনো অতীতকে ভুলে যাস না “।যাইনি ভুলে।

প্রশ্নকরা হয়েছিল দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলছেন আপনার অনুভূতি কেমন ? উত্তরটা ছিল এরকম যখন মাঠে নেমে জাতীয় সংগীতটা গাইতে শুরু করি তখন মনে হয় পৃথিবীতে এই নাসিরের কোন মূল্যই নেই তাই দেশের জন্য জীবনটা দিয়ে দিলেও কিছু আসে যায় না। ১৬ কোটি বাঙ্গালী আমাকে প্রেরনা জুগিয়ে আজ মাঠে পাঠিয়েছে তাই প্রতিটি সেকেন্ড মূল্যবান মনেহয়।নিজেকে উজাড় করে ভাল করার প্রবল চেষ্টা থাকে।

...ভাইয়ের বিয়েতে ফ্যামিলীর সবার মাঝে নাসির...ডানে প্রিয় দাদীর সাথে নাসির...

…ভাইয়ের বিয়েতে ফ্যামিলীর সবার মাঝে নাসির…ডানে প্রিয় দাদীর সাথে নাসির…

নাসিরের জীবন সংগ্রামে এগিয়ে আসা হয়েছে অনেক কষ্ট-যন্ত্রনা আর দঃসময় দুরে ঠেলে দেয়ার মাঝে।দেশের হয়ে খেলে পেয়েছেন যেমন খ্যাতি-সুনাম-যশ্ব তেমনি জুটেছে অনেকের ভালবাসা।সেই বিকেএসপিতে ভর্তি হবার সময় সাথে ছিলো জমানো ৩ হাজার টাকা।আর আজ জাতীয় দলে খেলার কারনেই হয়েছেন কোটিপতি।হয়েছে গাড়ী-বাড়ী।দেশের হয়ে খেলার কারনেই আজ নাসির প্রতিষ্টিত।সেই রংপুরের নাসিরকে আজ ক্রিকেট বিশ্ব চেনে বাংলাদেশের নাসির হিসেবে।তাই ভাল খেলে দেশকেও দিতে চান অনেক কিছু।এই অনেক কিছুই যেন এক একটি ম্যাচ ফিনিশিং মনমাতানো ব্যাটিংয়ের ঝলকানি।যেমনটি দিয়ে ভক্তদের কাছ থেকে পেয়েছেন মিষ্টার ফিনিশার ডাক।

...ক্রিকেটার নাসিরের বাবা-মা এবং ভাইয়ের সাথে লেখক সজিব...

…ক্রিকেটার নাসিরের বাবা-মা এবং ভাইয়ের সাথে লেখক সজিব…

 

No comments.

Leave a Reply